দিপু সিদ্দিকী :: পুরনো শহরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা বাড়ি, যেন নিজের বয়স লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ। উঠোনের ধারে কাঁঠাল গাছটা অল্প বাতাসেই দুলে ওঠে। এই বাড়ির ওপরে থাকেন মজিদ সাহেব—সরকারি অফিসের মধ্যম সারির একজন কর্মচারী।
পরিপাটি মানুষ, জীবনে অনুশাসনের বাইরে ভাবেন না খুব একটা। স্ত্রী রোকেয়া, তিন সন্তান নিয়ে তাঁর সাদামাটা সংসার। তবুও মাঝে মাঝে দিনশেষে সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন—এ যেন একান্ত নিজস্ব এক স্বাধীনতা।
নিচতলায় ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকে রফিক, তার স্ত্রী শিউলি এবং শালিকা জমিলা। মজিদের বাসার নিচে হলেও সম্পর্ক সৌজন্যমূলক।
জমিলা। মাত্র কুড়ি ছুঁইছুঁই। স্বপ্ন দেখে খুব ছোট ছোট—একটা নিজের সেলাই মেশিন, একটা কোণ ঘর, একটা নিজস্ব সকাল। সে জানালায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে—একটা অভ্যেস হয়ে গেছে।
সে জানে না কখন মজিদ সাহেব সেই আকাশ-দেখা অভ্যেসের অংশ হয়ে গেছে।
প্রথমবার চোখাচোখির মুহূর্তটা যেন মৃদু বিদ্যুতে কাঁপিয়ে দিল তার বুকের ভেতরটা। পরদিন আবার… তারপর প্রায় প্রতিদিন।
সে জানে, এ ভালোবাসা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য না। তবুও সে থামাতে পারে না নিজেকে।
শিউলি সব বোঝে। ননদের চোখের ভাষা, হঠাৎ থমকে যাওয়া, রাতে চুপ করে বসে থাকা—সব দেখে।
“তুই জানালায় এত কি দেখিস?” — শিউলি প্রশ্ন করে একদিন।
জমিলা হাসে, “আকাশ দেখি, ভাবী… তার থেকে কেউ যদি ডেকে বলে—‘তুই একা না।’”
শিউলি চুপ করে যায়। কিছু ভালোবাসা না বলা থাকাই ভালো, কিন্তু জমিলার চোখে সে যা দেখে, তা নীরব রাখা অসম্ভব।
পূর্ণিমার রাত। চাঁদ যেন অকারণে অনেক বেশি উজ্জ্বল। মজিদ অফিস থেকে ফিরছে, দরজার কাছেই জমিলা দাঁড়িয়ে।
“একটা কথা বলব?”
মজিদ থামে।
“আপনাকে ভালোবাসি। বলতেই হলো। অনেকদিন ধরে। জানি, আপনি পাবেন না আমাকে, আমিও আপনাকে চাইতে পারি না। তবুও এই ভালোবাসা থামে না।”
মজিদ স্তব্ধ। তিনি কিছু না বলে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে যান। শব্দ হয় না, তবুও সেই মুহূর্তটা জমিলার জীবনের সবচেয়ে গভীর শব্দহীনতা।
প্রকৃতির নিয়মেই দিন যেতে থাকে। পূর্ণিমা কেটে আসে আমাবস্যা। আকাশ কালো। জানালায় আলো নেই।
শিউলি কাছে এসে বলে,
“আজ জানালায় দাঁড়াসনি?”
জমিলা চোখ নামিয়ে ফেলে,
“ভাবী, চোখে জল থাকলে আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন লাগে।”
সেই রাত জমিলা কাটায় একা। চোখে পানি, মনে বোঝা। সে জানে, কোনো প্রেমই সহজ হয় না, কিন্তু অসমাপ্ত ভালোবাসাগুলো চিরকাল কষ্ট দেয়।
রোকেয়া মজিদের বদল বুঝতে পারে। সে কিছুই বলে না, কিন্তু রাতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে—
“তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো?”
মজিদ বলে, “না।”
কিন্তু সেই ‘না’ শব্দের পেছনে যেন দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে।
মজিদ জানে, সে কিছুই করেনি, তবুও একটা দৃষ্টি তার মনকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সে অস্বীকার করে, কিন্তু মনের গভীর কোণে জমে থাকা সেই আকাশ দেখা মেয়েটার ছায়া থেকে মুক্তি মেলে না।
একদিন জমিলা একটা চিঠি লেখে। কাউকে দেয় না। শুধু লেখে—
“আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগত। আপনি ছিলেন আকাশের মতো—ছোঁয়া যেত না, কিন্তু মাথার উপর ছিলেন। জানি আপনি আমার নন। তবুও আপনার জন্যই জানালায় দাঁড়াতাম। আজ জানালায় আমি দাঁড়াবো না। আকাশ থাকুক, কিন্তু তার নিচে আমার আর কোনো অপেক্ষা নেই।”
চিঠিটা সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। বাতাসে উড়ে যায় টুকরোগুলো।
মজিদ একদিন উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। জানালায় কেউ নেই।
একটা অভ্যাস হারিয়ে গেছে, একটা দৃষ্টি আর নেই।
কিন্তু আকাশ ঠিকই আছে।
আর আকাশেই রয়ে গেছে এক তরুণীর স্বপ্ন, ভালোবাসা, না-পাওয়ার নীরব কান্না।
আকাশ সব জানে।
Leave a Reply